শতবর্ষী গবেষণা ভবনটিও ভাঙা হচ্ছে!

হাতুড়ির আঘাতে আস্তে আস্তে ভাঙছে চমৎকার নকশাদার স্তম্ভ। গুঁড়িয়ে যাচ্ছে ২০ ইঞ্চি পুরু দেয়াল। শতবর্ষী সেগুনকাঠের সিঁড়ির বন্ধন ছিন্ন হচ্ছে দেয়ালের সঙ্গে। ইট-পলেস্তারার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে বড় বড় লোহার বিম।
বিশাল সবুজ প্রাঙ্গণের মাঝে লাল ইটের দোতলা এই কৃষি গবেষণা ভবনটির প্রতি তলার মেঝের আয়তন সাড়ে সাত হাজার বর্গফুটের মতো। ১৩ ফুট উঁচু সিলিংয়ের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে বড় বড় দরজা, শেড দেওয়া জানালা, চওড়া বারান্দা। সব হারিয়ে যাচ্ছে। সর্বশেষ ভবনটি ব্যবহার করেছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও তুলা উন্নয়ন বোর্ড।   
১৯০৯ সালে নির্মিত হয় এই ভবনটি। এর কাছাকাছি সময়ে নির্মিত হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল, উপাচার্যের বাংলো, পুরোনো হাইকোর্ট ভবন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ভবন। এই ভবনগুলো প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সংরক্ষিত তালিকায় রয়েছে। কিন্তু তালিকায় না থাকায় সুযোগসন্ধানীরা হাতুড়ি হেঁকে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে শত বছরের ঐতিহ্য। বহুতল ভবন প্রকল্পের বহুবিধ লাভ-লোভে আচ্ছন্ন এখন তুলা উন্নয়ন বোর্ড।
এর আগে এই খামারবাড়িতে গত বছরের সেপ্টেম্বরে ভাঙা হয়েছিল কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনের শতবর্ষী সাদা দোতলা ভবন। 
তুলা উন্নয়ন বোর্ডের ভবনটির বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাংলার কৃষিতে বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় যে বৈজ্ঞানিক গবেষণার সূত্রপাত হয়েছিল, তার চিহ্ন বহন করছে এই ভবনটি। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে ঢাকার গুরুত্ব বেড়ে যাওয়ায় প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা ও সরকারি কর্মকর্তাদের আবাসনের জন্য অনেক নতুন ভবন নির্মিত হয়। কার্জন হলসহ হেয়ার রোড, মিন্টো রোড, রমনা এলাকায় নির্মিত ভবনগুলোর বেশির ভাগ সংরক্ষিত ভবনের তালিকায় আছে। সে বিবেচনায় প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সংরক্ষিত ভবনের তালিকায় না থাকলেও ১৯০৯ সালে নির্মিত ‘ঐতিহাসিক’ এ ভবনটি না ভেঙে তা সংরক্ষণ করার তাগিদ দিয়েছেন তাঁরা।
ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে ৩৮ জন শ্রমিক দোতলা ভবনটি ভাঙার কাজ করছেন। এর মধ্যে ভবনের দুই পাশে দেয়ালের বেশ কিছু অংশ ভেঙে ফেলা হয়েছে। ভাঙা পড়েছে সিলিংয়ের বেশ কিছু অংশ, ভেতরের কয়েকটি দেয়াল। দোতলায় ওঠার মজবুত কাঠের সিঁড়ি বেয়ে খানিকটা উঠতেই চোখে পড়ল দেয়ালে সাঁটানো একটি পাথরের ফলক। তাতে লেখা, কৃষি বিভাগের পরিচালক ক্যানেথ ম্যাকলিনের স্মৃতির উদ্দেশে, যিনি ১৯৩৭ সালের ১৪ জানুয়ারি ঢাকায় মারা যান। ২৪ অক্টোবর ১৯১৪ সাল থেকে যিনি বাংলা অঞ্চলকে সেবা দিয়েছিলেন।
শ্রমিকদের নেতা নজরুল ইসলাম জানান, এক সপ্তাহ ধরে তাঁরা ভবনটি ভাঙার কাজ করছেন। মো. সাইফুল নামের এক ঠিকাদার ১৩ লাখ টাকায় এটি ভাঙার কাজ নিয়েছেন।
ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে ৩৮ জন শ্রমিক দোতলা ভবনটি ভাঙার কাজ করছেন। এর মধ্যে ভবনের দুই পাশে দেয়ালের বেশ কিছু অংশ ভেঙে ফেলা হয়েছে। ভাঙা পড়েছে সিলিংয়ের বেশ কিছু অংশ, ভেতরের কয়েকটি দেয়াল। দোতলায় ওঠার মজবুত কাঠের সিঁড়ি বেয়ে খানিকটা উঠতেই চোখে পড়ল দেয়ালে সাঁটানো একটি পাথরের ফলক। তাতে লেখা, কৃষি বিভাগের পরিচালক ক্যানেথ ম্যাকলিনের স্মৃতির উদ্দেশে, যিনি ১৯৩৭ সালের ১৪ জানুয়ারি ঢাকায় মারা যান। ২৪ অক্টোবর ১৯১৪ সাল থেকে যিনি বাংলা অঞ্চলকে সেবা দিয়েছিলেন।
শ্রমিকদের নেতা নজরুল ইসলাম জানান, এক সপ্তাহ ধরে তাঁরা ভবনটি ভাঙার কাজ করছেন। মো. সাইফুল নামের এক ঠিকাদার ১৩ লাখ টাকায় এটি ভাঙার কাজ নিয়েছেন।
ভবনটি ভাঙার কারণ জানার জন্য যোগাযোগ করা হয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. গোলাম মারুফের সঙ্গে। বৃহস্পতিবার দুপুরে তাঁর কার্যালয়ে গেলে বলা হয়, তিনি মন্ত্রণালয়ে আছেন। পরে মুঠোফোনে তিনি জানান, ভবনটি এখন তুলা উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় আছে। এর বাইরে আর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।
তুলা উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী পরিচালক মো. ফরিদ উদ্দিন বলেন, আইনি প্রক্রিয়া মেনেই ভবন ভাঙার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ভবনটির ৫০ শতাংশের বেশি ভাঙা হয়েছে।
ফরিদ উদ্দিন আরও বলেন, ২০১৩ সালে গণপূর্ত অধিদপ্তর ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে। তার দুই বছর পর এখান থেকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও তুলা উন্নয়ন বোর্ড সব ধরনের কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়। পরে ভবনটি ভাঙার ব্যাপারে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই পুরোনো ভবনটি ভেঙে এখানে একটি সাততলা ভবন নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)।
স্থাপত্য বিষয়ে কাজ করে এমন সংগঠন ও ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ১৯০৫ সালে ভারতে স্বতন্ত্রভাবে কৃষি বিভাগ প্রতিষ্ঠার এক বছরের মাথায় লর্ড কার্জনের নির্দেশে বাংলাতেও স্বতন্ত্র কৃষি বিভাগ চালু করা হয়। এর অংশ হিসেবে ফার্মগেট-সংলগ্ন এলাকায় ৬০০ একর জমি নিয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয়। সে সময়ে এখানে নির্মিত ১৮টি ভবনের মধ্যে এই ভবনটি ব্যবহৃত হতো গবেষণাগার হিসেবে। সে হিসেবে ভবনটির পরিচিতি ছিল ল্যাবরেটরি ভবন হিসেবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সাধারণ সম্পাদক কাজী এম আরিফ প্রথম আলোকে বলেন, একদিকে বাংলায় কৃষি গবেষণার সূত্রপাত ও ক্রমবিবর্তনের সাক্ষী এই ভবনটি। অন্যদিকে ভবনটির স্থাপত্যশৈলী ও প্রকাশভঙ্গি পূর্ব বাংলা ও ইউরোপের এক অনবদ্য সংমিশ্রণ। এসব বিবেচনায় এমন ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহনকারী এই ভবনটি ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত রীতিমতো অন্যায়।
কাজী এম আরিফ আরও বলেন, ‘বলা হচ্ছে ভবনটি দুর্বল ও ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু আমরা সেখানে গিয়ে দেখেছি, ভবনটি এখনো যে অবস্থায় আছে তাতে এটি সুন্দরভাবে সংরক্ষণ করা সম্ভব। আমরা দেশের সব পেশাজীবী স্থপতিদের পক্ষ থেকে এই কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ জানাচ্ছি।’

Post a Comment

Previous Post Next Post